History of BDRCS

 


রেডক্রিসেন্ট হলো আন্তর্জাতিক রেডক্রস অনুমোদিত মুসলিম বিশ্বে ত্রাণ ও মানবিক সাহায্য পরিচালনাকারী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। বিশ্বমানবতার সেবায় নিয়োজিত রেডক্রসের ইতিহাসের মধ্যে রেডক্রিসেন্টের উৎস নিহিত। সরকারের সহযোগী সংস্থা ও স্বেচ্ছাসেবী মানবিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি দুস্থ, পীড়িত, অসহায় ও বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীর অবস্থার উন্নয়নে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মূলত মুসলিম বিশ্বে ত্রাণ পুনর্বাসন ও মানবিক সাহায্য পরিচালনায় নিয়োজিত রেড ক্রিসেন্ট আন্তর্জাতিক রেডক্রসের ইতিহাসের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত।
১৮৫৯ সালের ২৪মে জুন সুইস তরুণ জন হ্যানরী ডুন্যান্ট ইতালীর সলফ্যারিনো নামক গ্রামে ফ্রান্স ও অষ্ট্রিয়ার মধ্যে সংঘটিত যুদ্ধে আহত সৈনিকদের আর্তনাদ দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। সোলফারিনো যুদ্ধের ভয়াবহতা নিয়ে তিনি ১৮৬২ সালে ‘অ্যা মেমোরি অফ সোলফারিনো’ নামক বইয়ে যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং আহত সৈনিকদের দুর্দশা তুলে ধরেন।একই সাথে যুদ্ধাহত মানবতার সেবায় একটি সংস্থা গঠনের আহবান জানান। তাঁর আহবানের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬৩ সালের ২৬ অক্টোবর ১৬টি দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত জেনেভা সম্মেলনে বিশ্বব্যাপী আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত আন্তর্জাতিক রেডক্রস গঠিত হয়। এই মতবাদ রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট কর্মী ও সদস্যদের সহায়তায় মানবীয় কাজের ক্ষেত্র ও পরিধি নির্দিষ্ট করে দেয়। পাশাপাশি এই কার্যক্রমের আদর্শ ও মানবীয় মূল্যবোধ প্রচারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দেয় এই মতবাদ। মূলনীতি গুলো হলো মানবতা, সমদর্শিতা, নিরপেক্ষতা, স্বাধীনতা, স্বেচ্ছাসেবা, একতা এবং সর্বজনীনতা।

বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির লক্ষ্য ও উদ্দেশগুলো নিম্নরূপ:
ক) মূলনীতিমালা অনুযায়ী মানবতার শক্তিতে যে কোনো অসুস্থতা বা দুর্যোগ আক্রান্ত মানুষের দুঃসময়ে পাশে থাকা এবং
তাদের উন্নয়নে সার্বিক তত্ত্বাবধায়ন করা;
খ) মূল নীতিমালার আলোকে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটিকে একটি শক্তিশালী ও কর্মদক্ষ জাতীয় প্রকল্পে উন্নীত করা;
গ) সকল জাতির মধ্যে শান্তি স্থাপন ও তা বজায় রাখা; এবং
ঘ) দুঃস্থ মানুষের পাশে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া।

বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি’র কার্যক্রম:
বিট্রিশ ভারতীয় রেডক্রস সোসাইটি এ্যাক্ট, ১৯২০ এর অধীনে এ অঞ্চলে রেডক্রস সোসাইটি গঠিত হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তান রেডক্রস সোসাইটি গঠিত হয়। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পাকিস্তান রেড ক্রস সোসাইটির আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সংস্থাটিকে কাজের অনুমতি দেয় এবং ৪ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি গঠিত হয়। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ত্রাণ ও পুনর্বাসন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য ও প্রশিক্ষণসহ বহুবিধ কর্মসূচির মাধ্যমে দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশের দুঃস্থ ও অসহায় মানুষের কল্যাণে বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখে আসছে।

নিম্নে বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইট’র কার্যক্রম তুলে ধরা হলো:
১। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি:  বাংলাদেশ রেডসিক্রেন্ট সোসাইটি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির আওতায় ৭ টি প্রকল্প পরিচালনা করে। যথা- 

ক. জলবায়ু পরিবর্তন ও অভিযোজন প্রকল্প: পরিবর্তনশীল আবহাওয়ার এলাকার মানুষের জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি, এলাকা ভিত্তিক দ্রæত সর্তক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা, আবহাওয়া জনিত দুর্যোগের ফলাফল এবং বিপর্যয়ের করণীয় বিষয়ে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে এ প্রকল্পটি চারটি জেলায় ৮ টি সম্ভাব্য দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলে কাজ করছে। প্রকল্পটির অধীনে ইতিমধ্যেই ৫৫,১৮০ জন মানুষ উপকার ভোগ করছে।

খ. সমাজ ভিত্তিক দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস: বন্যা, ঘুর্ণিঝড় ও জলাবদ্ধতায় আক্রান্ত চারটি জেলা জামালপুর, ভোলা, সাতক্ষীরা ও যশোরের ১০ টি দুর্যোগপ্রবণ এলাকার মানুষদের দুর্যোগ বিপর্যয় হ্রাস করার জন্য এ প্রকল্প কাজ করছে। এ প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো দুর্যোগপ্রবণ এলাকার মানুষ, স্থানীয় প্রশাসন জেলা প্রশাসন, সিভিল সার্জন, জেলার মৎস বিভাগ, যুব উন্নয়ন বিভাগের মধ্যে অংশীদারিত্ব তৈরি করা এবং স্থানীয়ভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠন গঠন করা। যেমনÑ সিডিএমসি (প্রতিটি কমিউনিটিতে ১৬জন সদস্য ৯৪জন পুরুষ ও ৬৬জন নারী) এবং সিডিআরটি (প্রতিটি কমিউনিটতে ২৫জন সদস্য- ১১৭জন পুরুষ ও ১০৩জন নারী) এর মধ্যে এলাকাভিত্তিক সংস্থাপন করা হয় যা এলাকাবাসীদের মাঝে প্রকল্পটিকে আপন করে নেয় এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে অংশ্রগ্রহণে অনুপ্রাণিত করে। 

গ. সমাজ ভিত্তিক উন্নয়ন প্রকল্প: সমষ্টি ভিত্তিক উন্নয়ন প্রকল্পটি দুর্যোগ মোকাবিলা, দারিদ্র্য দূরীকরণ, স্বাস্থ্য ও পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার উন্নয়ন এবং বিবিধ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়নের মাধ্যমে বিভিন্ন নির্বাচিত এলাকায় স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ২০১৭ সালের মধ্যে ১৬টি দুঃস্থ অঞ্চলের ৪০,০০০ এর বেশি মানুষের দুর্যোগ মোকাবিলার শক্তি বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের জীবনযাপন ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করছে। এ প্রকল্পের আওতায় শর্তবিহীন অনুদানের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ, সচেতনতা সৃষ্টি এবং অর্থের বিনিময়ে প্রাপ্তবয়স্ক ও কিশোরদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।

ঘ. ঝুঁকি হ্রাস: এ প্রকল্পের আওতায় ৫০টি প্রকল্প স্কুলের মাঝে ২০টি প্রধান এবং ৩০টি সাধারণ স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়ে থাকে। প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং প্রোগ্রামের মাধ্যমে মোট ২০,০০০ ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক ও এলাকাবাসী প্রত্যক্ষভাবে এবং আরো ৬০,০০০জন ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক ও এলাকাবাসী পরোক্ষভাবে উপকৃত হয়েছে।

ঙ. বিপদাপন্নতা থেকে সক্ষমতা প্রকল্প: সবচেয়ে নাজুক জনগণের সামাজিক চাহিদা ও নিরাপত্তার দায়িত্বে প্রতিনিয়িত ভালনারেবিলিটি টু রেজিলিয়েন্স প্রকল্প ‘ভিটুআর’। মূলত প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঝুঁকির সম্মুখীন নারী, শিশু বৃদ্ধ, পঙ্গুরা এই বিশেষসেবা লাভ করে।

চ. দুর্যোগ সাড়া দল: সময় মত সেবার জন্য যাতায়াত পথ পরিষ্কার রাখা, জীবন, সম্পত্তি ইত্যাদি রক্ষার জন্য আগেই ঘৃর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস প্রদান, মানুষদের নিরাপদ আশ্রয় সরিয়ে নেওয়া ইত্যাদি কাজ করা হয় এ প্রকল্পে।

২। স্বাস্থ্য কার্যক্রম:
বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি গ্রামীণ জনগণের পরিচালনাকে প্রাধান্য দিয়ে গ্রাম ও শহরভিত্তিক স্বাস্থ্য কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ পরবর্তী জরুরি চিকিৎসা প্রদান স্বাস্থ্য কর্মসূচির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। মা ও শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সংক্রামক ব্যাধির নিরাময়ে গুরুত্ব দেয়া হয়। ঢাকা শহরের অবস্থিত ৫১৫ শয্যাবিশিষ্ট হলি ফ্যামিলি রেডক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ দেশের ৫ টি হাসপাতাল, ৫টি মাতৃসদন, ৬০ টি গ্রামীণ মাতৃসদন কেন্দ্র, ২
টি চক্ষু ক্লিনিক, ৩টি বহিঃবিভাগ, ১টি মেডিকেল কলেজ ও ১টি নার্সিং কলেজর মাধ্যমে বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি জনস্বাস্থ্য সেবা দিয়ে যাচ্ছে।

৩। পারিবারিক যোগাযোগ পুনঃস্থাপন:
যুদ্ধ, সংঘাত, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং দেশভাগের ফলাফল হিসেবে মানুষ ঘরছাড়া হয়, স্বজনদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং কখনো হয়তো দেশ ছাড়াও হতে হয়। বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি’র ট্রেসিং সার্ভিসের মূল উদ্দেশ্য হলো পরিবারের মানুষদের একত্রিত করে দুশ্চিন্তা কমানো এবং পরিবার থেকে নিখোঁজ সদস্যদের খুঁজে বের করা। হারিয়ে যাওয়া পরিবারের সদস্যদের একত্রিত করার ক্ষেত্রেও কাজ করে থাকে।

৪। যুব ও স্বেচ্ছাসেবক কর্মসূচি:
দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বজুড়ে তরুণ ও স্বেচ্ছাসেবীদের সেবা দেওয়ার উৎসাহ আগ্রহকে মূল্যায়ন করেছে রেড ক্রিসেন্ট। বাংলাদেশে ১৯৭৬ সালে জে আরসি (জুনিয়র রেড ক্রস) তাদের কার্যক্রম শুরু করে এবং ১৯৮০ সালে রেড ক্রিসেন্ট ইয়ুথ গঠিত হয়। বর্তমানে এটি ৬৮টি ইউনিটে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার দক্ষ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ইউনিট ও স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে।

৫। প্রশিক্ষণ কর্মসূচি:
১৯৯৭ সালের সূচনার পর থেকেই প্রশিক্ষণ বিভাগ কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবীদের দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে বিডিআরসি এর ক্ষমতা বৃদ্ধি করে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন করে আসছে। প্রশিক্ষণের মূল সেগুলো হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, কমিউনিটি ভিত্তিক ফাস্ট এইড, জরুরী উদ্ধারকাজ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং দুর্যোগ সম্ভাবনা হ্রাস ইত্যাদি।

সারসংক্ষেপ
রেড ক্রিসেন্ট বাংলাদেশ সম্মিলিত ও সংগঠিত অত্যাচারে নিপীড়িত মানুষদের নিরাপত্তা ও সহযোগিতা প্রদান করে। বিভিন্ন প্রশাসন শিক্ষাকেন্দ্র, আইনরক্ষাকারী সংস্থা, সশস্ত্র বাহিনীর নামে আন্তর্জাতিক মানবিকতা আইন সম্পর্কে জানানোর ও তা প্রণয়নে সহযোগিতা করে। মানবতা, সমদর্শিতা, নিরপেক্ষতা, স্বাধীনতা, স্বেচ্ছাসেবা, একতা ও সর্বজনীনতা মূলনীতিকে সামনে রেখে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য কর্মসূচি, পারিবারিক যোগাযোগ পুনঃস্থাপন, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কর্মসূচি পরিচালনা করে।

Post a Comment

0 Comments